করোনাকালের আগে এমন কোনও দিন নেই যেদিন প্রেসক্লাবের নীচতলায় শহীদ রফিক সড়কে সাধনের মটরপার্টসের দোকানে বসিনি। কোনও দিন ১০ মিনিট, কোনও দিন ঘন্টাও পার করেছি, গল্প করে।
করোনার তাণ্ডবে নিত্যদিনের এই অভ্যাস বদলে গিয়েছিল। করোনার দাপট কমে গেলেও আগের মত স্বাভাবিক জীবনটায় ফিরে যেতে পারিনি। এ নিয়ে সাধনের এন্তার অভিযোগ ছিল। দেখা হলেই বলতো, "হেই নান্নু ভাই কই থাকেন আপনে, বসেন। " ওর চোখে পরলে থামতেই হত, তা হেঁটেই যাই আর রিক্সাতেই থাকি, ওর ডাক উপেক্ষা করা কঠিন ছিল।
সাধন আর আমি, আমরা দুজন, একই শহরে বড় হলেও সাধন আর আমাদের গ্রামের বাড়ি ছিল শহর থেকে ৫ মাইল দূরে পাশাপাশি গ্রামে। এজন্য আমাদের অন্তরের টানটা ছিল ভিন্নমাত্রার, গভীর।
সাধন প্রায় প্রতি সপ্তাহেই গ্রামের বাড়ি যেতো। দেখা হলেই বলতো "... দিন বাড়ি যামু, যাইবেন নাকি "। বাড়ি থেকে ফিরে এসে গ্রামের খুঁটিনাটি সব বলতো। ও যখন বলতো, এমন দরদ দিয়ে বলতো, মনে হত আমি আমার গ্রামের ডকুমেন্টারি দেখছি।
সাধনের মা খুব ভাল কাঁসুন্দি বানাতেন। যতদিন সাধনের মায়ের শরীর ভাল ছিল, সাধন ততদিন বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ্য মাস এলে খবরের কাগজে মোড়ানো, মিনারেল ওয়াটারের খালি বোতলে ভরা কাঁসুন্দি ডানে, বামে তাকিয়ে চট করে আমার হাতে গুঁজে দিত। বছরে কমপক্ষে এক লিটারের এক বোতল বরাদ্দ থাকতোই।
সাধন অসাধারণ মিশুক প্রকৃতির হাসিখুশি, গল্পবাজ মানুষ ছিল। যতদিন ধরে ওকে দেখেছি কোনও দিন কারও সাথে ঝগড়া, দুর্ব্যবহার করতে দেখিনি। হাসতো প্রাণখুলে, দুষ্টিমি আর রসিকতাতেও চারপাশের সবাইকে মাতিয়ে রাখতো।
দোকানের বিক্রিবাট্টা কমে এলে রসিকতা করে বলতো, নান্নু ভাই, দেখেনতো কায়দা করে আরেকবার আর্মি নামানো যায় কিনা। আমিও সিরিয়াস মুডে বলতাম ' ঠিক আছে দেখছি'। অপারেশন ক্লিনহার্ট, ওয়ান ইলেভেনের সময় শহরে যখন আর্মি এসেছে সাধনের দোকানে তখন মটরসাইকেল চালকদের হেলমেট কেনার উপচে পরা ভীড় জমতো।
আমাদের সাধন গতকাল রাতে হার্টএ্যাটাকে এ শহর, আমাদের আপন ভূবন ছেড়ে চিরতরে বিদায় নিয়ে চলে গেছে।
দু একজন বাদে " হেই নান্নু ভাই, কই থাকেন আপনে, বসেন।" বলার মত মানুষ এই প্রিয়, পুরোনো শহরে রইল না।
প্রার্থনা করি, পরমপ্রভূ তোমাকে স্বর্গবাসী করুন।